খাদ্যাভাস, ভুল জীবনযাপন, পরিবেশের বিরুপ প্রভাব, বংশগত সমস্যা – কারণ যাই হোক না কেন কিছু রোগ শরীরে বাসা বেধেই ফেলে। এমন রোগের ভেতর বাত বা আর্থ্রাইটিস অন্যতম।
অনেক সময় বাতব্যাথার চিকিৎসার জন্য ঔষধ প্রয়োজন হতে পারে, তবে ঔষধ সেবনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। এমনকি ক্ষতিসাধন হতে পারে বিভিন্ন অন্ত্রেরও। তাই প্রাকৃতিক উপায়কে প্রতিকারের পথ হিসেবে বেছে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ। আর প্রাকৃতিক সমাধানগুলো সাধারণত সহজলভ্য এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত হওয়ায় অনেকের জন্য এটি বেশি সুবিধাজনক। মুলত জীবনযাপনের ধরণ ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে এই রোগ অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এখন আসুন প্রাকৃতিক উপায় গুলো জেনে নেয়া যাক –
১। পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন
আমাদের শরীর সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে ঘুমের ভূমিকা অনেক। রাতে ঘুম ভালো না হলে শরীরের ওপরে পড়বে মারাত্মক প্রভাব। সেজন্য বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমের দিকে মনোযোগ দিতে বলেন। এমনকি পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম ব্যাথা প্রতিরোধে এবং অনেক সময় ব্যাথা নিরাময়ে বেশ কার্যকর। তাই পর্যাপ্ত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন।
২। হাঁটাহাটি ও বিশ্রামে সমতা বজায় রাখুন
যখন আপনি হাঁটাহাটি করেন তখন হাড়ের জয়েন্টের মাঝে বিদ্যমান সাইনোভিয়াল তরলটি গরম হয়ে যায় এবং জয়েন্টের মধ্যকার ঘর্ষণ কমিয়ে দেয়। ফলে হাঁটাচলার কারণে বাতের ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এছাড়াও হাঁটাচলার কারণে জয়েন্টের মাংসপেশীগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যা প্রাকৃতিক ভাবে আপনার বাত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু শুধু হাঁটাহাটি আপনাকে ক্লান্ত করে দিতে পারে তাই পাশপাশি বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। যেমন হাঁটাচলা করবেন আবার বিশ্রামও নিবেন। অতিরিক্ত কিছু করতে যাবেন না বরং সমতা রক্ষা করুন হাটাহাটি ও বিশ্রামে।
৩। নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম আপনাকে প্রাকৃতিকভাবে রোগ থেকে রক্ষা করবে এবং জয়েন্টের ব্যাথার জায়গাটিকে নমণীয় রাখবে। তাই দৈনিক স্ট্রেচিং ব্যায়াম করুন এবং শরীরের জড়তা দূর করুন। এছাড়াও নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের জয়েন্টগুলো মজবুত করতে সাহায্য করবে এবং ব্যাথা থেকে রক্ষা করবে। এর সাথে সাইকেল চালানো কিংবা যোগব্যায়াম করা যেতে পারে।
৪। সূর্যালোকে ভিটামিন ডি গ্রহণ করুন
আমরা সবাই জানি সকাল ১০ ট থেকে দুপুর ২ ট পর্যন্ত সূর্যের আলোতে অধিক পরিমাণে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। তাই এই সময়ে নিয়মিত ২০ থেকে ৩০ মিনিট রোদ পোহালে শারীরিক জয়েন্ট গুলোতে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম উৎপাদনে সহায়ক হবে যা প্রাকৃতিকভাবে আপনাকে বাত ব্যাথার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
৫। শরীরকে হাইড্রেট রাখুন
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় শরীরকে হাইড্রেট রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পানের কোন বিকল্প নেই। এই প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ পানি আপনার বাতের ব্যাথার সমস্যা যেমন দূর করবে আবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করবে।
৬। স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করুন
- আদা ও রসুন:
আদা ও রসুনে প্রদাহনাশক গুণ রয়েছে। নিয়মিত আদা ও রসুন খেলে বাতের ব্যথা কমতে পারে। এছাড়া দারুচিনিতেও প্রদাহনাশক গুণ রয়েছে।
- হলুদ:
ব্যথা সারাতে আদর্শ একটি মসলা হলুদ। এর সংক্রমণরোধী উপাদান শরীর ও জয়েন্টের ব্যথা সারাতে বেশ উপকারী।
- ব্রোকলি:
ব্রোকলিতে সালফোরাফেন সহ একাধিক প্রদাহনাশক উপাদান রয়েছে, যা বাতের ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।
- আখরোট:
আখরোট ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ, যা আর্থারাইটিসের ব্যথা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
- পালংশাক:
পালংশাকে ক্যাম্পফেরল নামক অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে, যা বাতের ব্যথা কমাতে কার্যকর।
- ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার:
ভিটামিন ডি আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যা হাড়ের গঠনের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। তাই সুস্থ ব্যাথাহীন হাড় ও জয়েন্টের জন্য ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া জরুরি।
স্যামন, ম্যাকেরেল ও সারডিনের মতো মাছগুলোতে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভিটামিন ডি থাকে, যা বাতের ব্যথা কমাতে সহায়ক। এছাড়াও ডিম, দুধ কমলার জুস, মাশরুম, সোয়া মিল্ক ইত্যাদিতে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার:
দুধ, দুগ্ধজাত খাদ্য ও ছোট মাছ ক্যালসিয়াম ঘাটতি পূরণ করে, এবং লাল চাল, লাল আটা ও ভুট্টায় থাকা ভিটামিন বি ১২ বাতের রোগীদের জন্য উপকারী।
- অলিভ অয়েল:
অলিভ অয়েলের মধ্যে রয়েছে প্রদাহনাশক গুণ, যা ব্যাথা উপশমে কার্যকর। এটি রান্নার তেল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন অথবা আক্রান্ত স্থানে মেসেজ করতে পারেন।
- মেথি:
মেথি বীজে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান রয়েছে, যা ব্যাথা এবং প্রদাহ কমায়। মেথি বীজ গুঁড়া করে পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খাওয়া যেতে পারে।
তবে মনে রাখবেন সব ধরনের খাবার বাত ব্যাথা নিরাময়ের জন্য উপযোগী নাও হতে পারে। যে সব খাবার বাতের ব্যাথা বাড়িয়ে দিতে পারে যেসব খাবারের তালিকা হলো –
- অতিরিক্ত চিনি:
ক্যান্ডি, ঠাণ্ডা পানীয় এবং আইসক্রিমে থাকা অতিরিক্ত চিনি বাতের সমস্যা বৃদ্ধি করতে পারে।
- প্রক্রিয়াজাত মাংস ও রেড মিট:
এই ধরনের মাংসে ইন্টারলিউকিন, সি-রিয়্যাক্টিভ প্রোটিন ও হোমোসিস্টেইনের মতো উপাদান থাকে, যা প্রদাহ এবং বাতের ব্যথা বাড়াতে পারে।
- গ্লুটেন সমৃদ্ধ খাবার:
গম এবং বার্লির মতো শস্যে থাকা গ্লুটেন প্রোটিন বাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- অতিরিক্ত লবণ:
সোডিয়ামের উচ্চ মাত্রা বাতের ব্যথা বৃদ্ধি করতে পারে, তাই অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলা উচিত।
- নির্দিষ্ট কিছু ফল ও খাবার:
টমেটো, লেবু, আমড়া, শিকড়জাতীয় খাবার, ময়দা এবং সাদা চিনি খেলে বাতের ব্যথা বৃদ্ধি পেতে পারে।
৭। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
অতিরিক্ত ওজন বাত ব্যথার অন্যতম কারণ। বাতের ব্যথা সাধারণত ওজন বহনকারী জয়েন্টে হয়ে থাকে। যেমন হিপ বা হাঁটু। তাই এই ব্যথা কমাতে ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। প্রোটিন জাতীয় যে সব খাবারে ক্যালরি কম সেসব খাবার বেশি খেয়ে ওজন কমানোর পদ্ধতি সবচেয়ে সহজ, কার্যকরী, মুখরোচক, প্রাকৃতিক ও কম কষ্টের। এছাড়াও সুগারযুক্ত কোমল পানীয় ও ফলের রস বর্জন করতে হবে ও বেশি করে পানি পান করতে হবে।
৮। জয়েন্টে ঠান্ডা বা গরম সেঁক দিন
গরম বা ঠান্ডা সেঁক বাতের ব্যাথা উপশমে খুব কার্যকর। ব্যাথা থাকলে ঠান্ডা সেঁক দিতে পারেন, এবং পেশী শিথিল করার জন্য গরম সেঁক দিতে পারেন।
৯। মাসাজ নিন
বাত ব্যাথা বা আর্থ্রাইটিসে মাসাজ অত্যন্ত উপকারি। নিয়মিত মাসাজে বাত ব্যাথায় আরাম পাওয়া যায় এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধও হয়। তবে মাসাজ গুলো অবশ্যই মেডিকেল সাইন্স অনুযায়ী হতে হবে নইলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
১০। মেডিটেশন করুন
সকল চিন্তা ভাবনা থেকে মস্তিষ্ককে মুক্তি দিতে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করা যা আপনাকে সাময়িক ভাবে বাত ব্যাথা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
১১। শীতকালে ভারী পোশাক পরিধান করুন
শীতকালে ভারী পোশাক পরিধান করুন এবং নিজেকে উষ্ণ রাখুন, এতে তাপমাত্রার ওঠানামা এড়ানো যাবে। কারণ প্রচন্ড ঠান্ডায় আপনার বাতের ব্যাথা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বাড়ির ভেতরে থাকুন, প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যাওয়াই ভালো।
১২। মানুষের সাথে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করুন
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সমাজে সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে, তারা অন্যদের তুলনায় আর্থ্রাইটিসের ব্যথায় কম ভুগেন। আসলে মানুষ্বের সংস্পর্শে থাকলে ব্যাথার বোধটা সব সময় কাজ কপরে না তাই সবার সাথে ভাল সময় কাটান।