কোমর ব্যথা একটি খুবই সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রায় সব পুরুষই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে অনুভব করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ জীবনের এক সময় কোমর ব্যথায় ভুগেছেন।এর ভেতর সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর থেকে পুরুষের এই ব্যথা বেশি দেখা দেয়। এ বয়সে অনেকেই পেশাগত জীবনে দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন, যা কোমরের মাংসপেশির নমনীয়তা কমিয়ে দেয়। ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল জানিয়েছেন, এ কারণে মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং ব্যথার সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া, যাঁরা পরিবারের দায়িত্ব পালন নিয়ে মানসিক চাপ অনুভব করেন, তাঁদের মধ্যে কোমর ব্যথার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। মানসিক চাপ মাংসপেশির টান ও ব্যথা আরও বাড়িয়ে তোলে। শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় কোমরের মাংসপেশি সবচেয়ে বেশি দুর্বল এবং সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কারণ হলো, কোমরের পেশি খুব ঘন ঘন শিথিল ও সংকুচিত হয়। সাধারণত “কোমর ব্যথা” বলতে “লো ব্যাক পেইন” বোঝানো হয়।
পুরুষের কোমর ব্যথার কারণ, যে গুলো সাধারণ অবস্থায় ফেস করা হয়ঃ
১। সঠিকভাবে না বসা
২। দীর্ঘক্ষণ বসার ধরনে ভুল
৩। ড্রাইভিংয়ের সময় সঠিকভাবে না বসা
৪। পেশি, লিগামেন্ট, ডিস্ক ও স্নায়ুর রোগ
৫। হাড়ের ক্ষয়
৬। পূর্বের কোন আঘাত
৭। ভুল ব্যায়াম
৮। অতিরিক্ত ওজন
৯। দুশ্চিন্তা ইত্যাদি
এবার আসুন পুরুষের কোমর ব্যথার কিছু গুরুত্বপূর্ন কারণ নিয়ে কথা বলি সাথে লক্ষন ও প্রতিকার গুলো জানিঃ
১। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম
অতিরিক্ত পরিশ্রম, হঠাৎ ভারী জিনিস তোলার ফলে কোমরে মাংসপেশীতে টান লেগে ব্যাথার সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কাজের সময় কোমর ব্যথার প্রধান কারণ শুধু ভুলভাবে অবস্থান করা অর্থাৎ আপনি যদি বসা, হাঁটা কিংবা দাঁড়ানোর সময় সঠিকভাবে অবস্থান না করেন তাহলে কোমরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এটি কোমর ব্যথার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এছারাও কোমর ব্যথার আরেকটি কারণ হলো মাংসপেশি কিংবা টেনডনে মচকানি।
লক্ষণ:
- কোমরের পেশীতে তীব্র ব্যথা।
- শরীর বাঁকাতে বা সোজা করতে কষ্ট হওয়া।
- হঠাৎ ভারী জিনিস তোলার পর ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়া।
প্রতিকার: ভারী জিনিস তুলতে হলে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। হাঁটু বাঁকা করে বসে জিনিস তুলুন এবং একবারে অতিরিক্ত ভার বহন থেকে বিরত থাকুন। কাজের সময় সঠিক ভঙ্গিতে বসা, হাঁটা এবং দাঁড়ানোর অভ্যাস করতে হবে। প্রয়োজনে পোশ্চার কারেকশন জাতীয় অ্যাডাপটিভ ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন।
২। মেরুদণ্ডের রোগ
পিএলআইডি (প্রোল্যাপ্সড লাম্বার ইন্টার ভার্টিব্রাল ডিস্ক):
পুরুষের কোমর ব্যথার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হলো মেরুদণ্ডের রোগ পিএলআইডি বা প্রোল্যাপ্সড লাম্বার ইন্টার ভার্টিব্রাল ডিস্ক। এ ক্ষেত্রে কোমরের মেরুদণ্ডের দুই হাড়ের মাঝখানে ডিস্ক নামে যে তরুণাস্থি থাকে, সেটি পেছনে বা পাশের দিকে বেরিয়ে এসে স্পাইনাল কর্ড এর থেকে বেরিয়ে আসা নার্ভের গোড়ায় চাপ দেয় ফলে ব্যাথা হয় ।
লক্ষণ:
- কোমরের নিচে এবং পায়ের দিকে তীব্র ব্যথা।
- হাঁটা বা দাঁড়াতে অসুবিধা।
- মাংসপেশি দুর্বলতা বা পায়ে ঝিঁঝি অনুভব হওয়া।
প্রতিকার: চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথা উপশমের ওষুধ বা বিভিন্ন থেরাপি গ্রহণ করুন। গুরুতর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। লাম্বার করসেট অথবা পোশ্চার কারেকশন জাতীয় অ্যাডাপটিভ ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন।
লাম্বার স্পনডোলাইসিসঃ
আমাদের কোমরের পাঁচটি হাড় আছে। এই হাড়গুলো যদি পুরুষদের বয়সের কারণে বা বংশগত কারণে ক্ষয় হয়ে যায়, তখন তাকে লাম্বার স্পনডোলাইসিস বলে। এই ক্ষয়ের ফলে কোমরে ব্যাথা হয়।
লক্ষণ:
- কোমরে স্থায়ী বা নিয়মিত ব্যথা।
- দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার পর ব্যথা বৃদ্ধি।
- কোমর বাঁকাতে বা সোজা করতে অসুবিধা।
প্রতিকার: নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন,হিট থেরাপী নিন যা মেরুদণ্ডকে সচল রাখবে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করুন। প্রয়োজনে লাম্বার করসেট জাতীয় অ্যাডাপটিভ ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন।
৩। পেশাগত কারণ
যারা দীর্ঘ সময় ধরে বসে কাজ করেন, যেমন অফিসে দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা, এই সকল কাজ যে সকল পুরুষ করে থাকেন তাদের কোমরে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে থাকলে পিঠের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায় এবং কোমর ব্যথা সৃষ্টি করে। এছাড়াও পেশাগত কারণে যে সকল পুরুষ কোমর বাঁকা করে কাজ করতে হয় তাদের কোমর ব্যথা হয়।
লক্ষণ:
- দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর কোমরে ব্যথা।
- পিঠের পেশিগুলো দুর্বল হওয়া।
- কোমর বাঁকা করে কাজ করার পর ব্যথা বৃদ্ধি পাওয়া।
প্রতিকার: যারা দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন, তাদের প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর উঠা-বসা করা উচিত। সঠিক উচ্চতার চেয়ার এবং ডেস্ক ব্যবহার করুন। কোমরের পেশি শক্তিশালী করতে ফিজিওথেরাপি বা হালকা ব্যায়াম করতে পারেন।পোশ্চার কারেকশন জাতীয় অ্যাডাপটিভ ডিভাইস ব্যবহার করতে পারেন।
৪। জীবনযাপন সংক্রান্ত সমস্যা
পুরুষের খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত ওজন, অপুষ্টি, ধূমপান, অপর্যাপ্ত ঘুম এবং নিয়মিত শরীরচর্চার অভাব কোমর ব্যথার কারণ। ফলে ওজন বাড়লে মেরুদণ্ড ও পেশির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা কোমর ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া অতিরিক্ত মানসিক চাপ কোমড়ে ব্যাথার সৃষ্টি করতে পারে।
লক্ষণ:
- অতিরিক্ত ওজনের কারণে কোমরে চাপ অনুভব করা।
- অপুষ্টি বা দুর্বল শরীরের জন্য ব্যথার বৃদ্ধি।
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে ক্লান্তি ও কোমর ব্যথা।
প্রতিকার: পুরুষদের সুষম খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা উচিত। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে এবং মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন অনুশীলন করতে হবে।
৫। অস্টিওআর্থ্রাইটিস
পুরুষদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেরুদণ্ডের জয়েন্টে যে ক্ষয় হয় তা অস্টিওআর্থ্রাইটিস নামে পরিচিত। এই ক্ষয়ের ফলে কোমর ও মেরুদণ্ডে ব্যথা সৃষ্টি হয়। অস্টিওআর্থ্রাইটিস, যা ডিজেনারেটিভ জয়েন্ট ডিজিজ নামেও পরিচিত, যা দেখা দেয় আর্টিকুলার কার্টিলেজের ব্যবহারিক ক্ষতি ও ক্রমাগত ক্ষয়ের কারণে। এই রোগ বয়স্ক মানুষদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। এটি বিশ্বে অক্ষমতার চতুর্থ প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
লক্ষণ:
- কোমর ও মেরুদণ্ডের জয়েন্টে স্থায়ী ব্যথা।
- চলাচলে কষ্ট হওয়া।
- জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া বা লক হয়ে যাওয়া।
প্রতিকার: ওষুধ, হট অ্যান্ড কোল্ড থেরাপি, ফিজিওথেরাপি এবং হালকা ব্যায়ামের মাধ্যমে জয়েন্টের কার্যকারিতা বজায় রাখুন।
৬। স্নায়ুর সমস্যা বা সায়াটিকা
কোমর ব্যথার একটি সাধারণ কারণ হলো সায়াটিকা, যেখানে সায়াটিক স্নায়ুতে প্রদাহ বা চাপ সৃষ্টি হয়। এই স্নায়ুটি কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত প্রসারিত, তাই এতে চাপ পড়লে কোমর থেকে পা পর্যন্ত ব্যথা হতে পারে। এছাড়া বয়সজনিত ক্ষয়রোগ, কোমরের শক্ত হাড় বা কশেরুকার স্থানচ্যুতি, লাম্বার স্পাইনাল ক্যানেল স্টেনসিস বা স্নায়ু চলাচলের পথ সরু হয়ে গেলে সায়াটিকা হতে পারে।
লক্ষণ:
- কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত ব্যথা।
- স্নায়ুর প্রদাহের কারণে পা দুর্বল হয়ে যাওয়া।
- পায়ে ঝিঁঝি বা অবশ অনুভূতি।
প্রতিকার: বিশ্রাম, হিট থেরাপী,হিট মাসাজার, এবং ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করতে হবে। গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে ইঞ্জেকশন বা অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে। সঠিক ভঙ্গিতে বসা এবং ভারী কাজ এড়িয়ে চলতে হবে।
এবার আসুন একটা চার্টে আমরা দেখে নেই পুরুষের কোমর ব্যাথার কারণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থাঃ
কারণ | প্রতিরোধে করণীয় |
ভারী জিনিস তোলা | জিনিস তোলার সময় সঠিক ভঙ্গি মেনে চলুন, হাঁটু বাঁকিয়ে তুলুন। |
দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা | প্রতি ৩০-৪৫ মিনিটে উঠে একটু হাঁটুন এবং স্ট্রেচিং করুন। |
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন | নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। |
অতিরিক্ত ওজন | ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন। |
সঠিক ভঙ্গিতে না বসা বা দাঁড়ানো | বসার সময় সোজা হয়ে বসুন এবং সাপোর্ট দেওয়ার জন্য ব্যাকরেস্ট ব্যবহার করুন। |
দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো | প্রতি ঘণ্টায় বিরতি নিন এবং শরীরকে স্ট্রেচ করুন। |
ঘুমানোর সময় ভুল ভঙ্গি | হার্ড বা মেডিক্যাল ম্যাট্রেস ব্যবহার করুন এবং সঠিক পিলো ব্যবহার করুন। |
পেশির দুর্বলতা বা ফিটনেসের অভাব | কোমর এবং পিঠের পেশির শক্তি বাড়ানোর জন্য ব্যায়াম করুন। |
আঘাত বা দুর্ঘটনা | ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার সময় সতর্ক থাকুন এবং সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করুন। |
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ | ধ্যান, যোগব্যায়াম, বা রিলাক্সেশনের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করুন। |
উপসংহার:
পুরুষের কোমর ব্যথার প্রকৃতি ও কারণ অনুযায়ী এর লক্ষণগুলো ভিন্ন হতে পারে। প্রতিটি কারণের জন্য নির্ধারিত প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তবে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার ক্ষেত্রে দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি এবং নিয়মিত শরীরচর্চা কোমর ব্যথা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।