হাঁটু মানুষের দৈনন্দিন চলাফেরায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বিভিন্ন কারণে হাটুঁর জয়েন্টে ব্যাথা হতে পারে। যেমন আঘাতজনিত ইনজুরি, আর্থ্রাইটিস, অতিরিক্ত পরিশ্রম, বয়সজনিত ক্ষয় ইত্যাদি। তাই যখন জয়েন্টে ব্যাথা দেখা দেয়, তখন আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সে সময় আমরা ব্যাথা কমানোর জন্য উপায় খুঁজে ফিরি।
আমাদের দেশে হাঁটু ব্যাথা কমানোর জন্য প্রচলিত যে সকল উপায় আছে তার ভিতর ঠান্ডা এবং গরম চিকিৎসা দুটিই বেশ জনপ্রিয় এবং বিজ্ঞানসম্মত ও পরীক্ষিত।
এখন প্রশ্ন হলো, কোনটি ভালো ঠান্ডা না গরম সেঁক? আসুন জেনে নেয়া যাক।
হাঁটু ব্যথার জন্য কার্যকরি : ঠান্ডা নাকি গরম সেঁক?
হাঁটু ব্যথার জন্য ঠান্ডা ও গরম চিকিৎসা উভয়ই কার্যকর হতে পারে, তবে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, নতুন আঘাতের জন্য ঠান্ডা এবং পুরানো ব্যথার জন্য গরম চিকিৎসা বেশি উপকারী। তবে, প্রত্যেকের শরীর ও অবস্থা ভিন্ন। তাই কখন ঠান্ডা আর কখন গরম সেঁক দিবেন তা জানা জরুরি।
হাঁটুতে কখন গরম সেঁক দেবেন?
আপনি যদি দীর্ঘদিন ধরে হাঁটু ব্যথায় ভুগে থাকেন, তাহলে সেই স্থানে গরম পানির সেঁক খুবই কার্যকর হবে। কারণ তাপ প্রয়োগে বস্তুর প্রসারণ ঘটে – এই নীতি অনুসরণ করে যখন হাঁটুতে গরম সেঁক দেওয়া হয়, তখন সেখানকার রক্তনালি প্রসারিত হয় এবং সেখানে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়। রক্তপ্রবাহ বাড়ার কারণে সেখানকার পেইন মেডিয়েটরস বা ব্যথা সৃষ্টিকারী রাসায়নিক, যেমন প্রস্টাগ্লান্ডিন, লিউকোট্রায়েন্স ইত্যাদি দ্রুত সরে যেতে থাকে। ফলে নতুন রক্তপ্রবাহ চলাচল বেড়ে গিয়ে হাঁটুর সেরে ওঠার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
বাড়িতে হাঁটুর ব্যাথায় গরম সেঁক দেওয়া ছাড়াও কখনো কখনো হাসপাতালে থার্মাল থেরাপি হিসেবে ইনফ্রারেড রে (আইআরআর), মাইক্রোওয়েভ ডায়াথার্মি, প্যারাফিন ওয়াক্স বাথ ইত্যাদি ইলেকট্রো থেরাপিউটিক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সহজলভ্য হিসেবে হিট মাসাজার দিয়ে হিট থেরাপি ও হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ভরে একজন হাঁটু ব্যাথার রোগী বাসায় গরম সেঁক নিয়ে ব্যথা কমাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিবার ১০ থেকে ১৫ মিনিট করে দিনে ৩ থেকে ৪ বেলা গরম পানির সেঁক নেওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, নয় তো অসাবধানতায় ত্বক পুড়ে যেতে পারে। যাদের অনুভূতি কম, যেমন ডায়াবেটিসের রোগী, তাদের একটু বেশি সতর্কতা দরকার।
হাঁটুতে কখন ঠান্ডা সেঁক দেবেন?
যখন হাঁটুতে নতুন কোনো আঘাত বা ইনজুরি হয়, তখন সেখানকার প্রদাহ কমাতে ৫ থেকে ৭ মিনিট করে দুই ঘণ্টা পরপর বরফের সেঁক দেয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণত তীব্র হাঁটু ব্যাথার সময়কাল ০ থেকে ৭ দিন। তখন বরফ সেঁক খুবই ফলপ্রসূ একটি উপায়। হাঁটু ফোলা থাকলেও বরফের সেঁক খুবই কার্যকর। বরফের সেঁক দিলে প্রথমে সেখানে রক্তনালি সংকুচিত হয়। এতে ইনফ্লামেটরি মেডিয়েটরস বা প্রদাহ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। ঠিক তার ১০ মিনিট পর রক্তনালিগুলো প্রসারিত হয়ে যাবে। একে ‘লুইস হান্টিং রিঅ্যাকশন’ বলা হয়। তখন আবার বর্ধিত রক্তনালি জমা হওয়া পেইন মেডিয়েটরগুলো সরিয়ে নিয়ে যাবে। এতে ব্যথা ও প্রদাহ দুটিই কমে আসবে। হাঁটুতে স্পোর্টস ইনজুরি বা ট্রমার ক্ষেত্রে ক্রায়োথেরাপি বা বরফ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার অন্যতম একটি হাতিয়ার। কখনো পুরোনো ব্যথার ক্ষেত্রেও মাংসপেশির খিঁচুনি কমাতে বরফের সেঁক খুব কাজ করে থাকে। বরফের সেঁক দেওয়ার জন্য সার্কুলার (বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে) গতি কিংবা স্ট্রোকিং (এক জায়গায় চেপে চেপে) নিয়মে দেওয়া যেতে পারে।
এবার আসুন গরম ও ঠাণ্ডা সেঁক এর তুলনামূলক পার্থক্যগুলী দেখে নেয়া যাক যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়।
করণীয় | গরম সেঁক | ঠান্ডা সেঁক |
কখন ব্যবহার করবেন | দীর্ঘদিন ধরে চলমান হাঁটু ব্যথা বা পুরোনো ইনজুরির ক্ষেত্রে গরম সেঁক কার্যকর। | নতুন আঘাত বা ইনজুরির ক্ষেত্রে (০-৭ দিনের মধ্যে) ঠান্ডা সেঁক ব্যবহার করা হয়। |
ব্যথার সঠিক ধরন নির্ণয় | পুরোনো ব্যথা, মাংসপেশির খিঁচুনি বা জয়েন্টের ব্যথার ক্ষেত্রে। | তীব্র ব্যথা, হাঁটু ফোলা, ইনফ্লামেশন বা নতুন আঘাতের ক্ষেত্রে। |
কীভাবে কাজ করে | গরম সেঁক রক্তনালি প্রসারিত করে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়, পেইন মেডিয়েটরস সরিয়ে নেয়। | ঠান্ডা সেঁক রক্তনালি সংকুচিত করে প্রদাহ সৃষ্টি করা রাসায়নিকের প্রবেশ বন্ধ করে এবং প্রদাহ কমায়। |
সেঁক নেয়ার প্রক্রিয়া | হট ওয়াটার ব্যাগ,গরম তোয়ালে, হিট ম্যাসাজার, ইনফ্রারেড রে (আইআরআর), মাইক্রোওয়েভ ডায়াথার্মি, প্যারাফিন ওয়াক্স বাথ। | বরফ সেঁক দুই ঘণ্টা পরপর ৫-৭ মিনিট করে দেওয়া হয়। |
ব্যবহার করার সময়কাল | প্রতিবার ১০-১৫ মিনিট করে দিনে ৩-৪ বার গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে। | প্রতিবার ৫-৭ মিনিট করে দিনে ৩-৪ বার দুই ঘণ্টা পরপর। |
ঠান্ডা ও গরম সেঁকের উপকরণ
গরম সেঁকের উপকরণ গরম থেরাপির জন্য হট ওয়াটার ব্যাগ, হিটিং প্যাড বা উষ্ণ তোয়ালে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাপমাত্রা খুব বেশি গরম হওয়া উচিত নয়।
হাঁটুর ব্যথা বা পেশির টান থেকে মুক্তি পেতে অনেক সময় আমরা হিট মাসাজার অথবা গরম সেঁক ব্যবহার করে থাকি। উভয় পদ্ধতিই আরাম এবং উপশম প্রদান করতে সক্ষম, তবে এদের কার্যকারিতা কিছুটা ভিন্ন। চলুন হিট মাসাজার ও গরম সেঁক উভয় পদ্ধতির বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক –
বৈশিষ্ট্য | হিট মাসাজার | গরম সেঁক |
কার্যপ্রণালী | রিচার্জেবল ব্যাটারিতে চালিত, যা মাংসপেশীতে হিটিং ও ভাইব্রেশন তৈরি করে | গরম পানি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট স্থানে তাপ প্রদান করে |
কাজের ধরন | ভাইব্রেশন + তাপ সরবরাহ | শুধুমাত্র তাপ সরবরাহ |
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ | সাধারণত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অপশন থাকে | তাপমাত্রা নির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না |
ব্যবহারের সময়কাল | স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময়সীমা নির্ধারণ করা যায় | নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সময় নির্ধারণ করতে হয় |
প্রয়োগের স্থান | মাংসপেশী এবং শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে | শরীরের যেকোনো ব্যথাযুক্ত বা প্রদাহিত স্থানে |
উপকারিতা | দ্রুত রিলাক্সেশনের জন্য গভীর মাসাজ ও তাপ প্রদান করে | সহজলভ্য এবং যেকোনো সময় গরম সেঁক নেয়া যায় |
রক্ষণাবেক্ষণ | নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন | বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন নেই |
ঠাণ্ডা সেঁকের উপকরণ ঠান্ডা থেরাপির জন্য আইস প্যাক, ঠান্ডা জল, বা ফ্রোজেন ভেজিটেবল প্যাক সহজলভ্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঠান্ডা অথবা গরম সেঁক দেওয়ার আগে সতর্কতা
গরম সেঁকে উত্তাপটা হতে হবে কোমল ও সহনীয়, যেন ত্বকে সরাসরি দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে তোয়ালে ব্যবহার করা যাতে পারে। আর আরামদায়ক উত্তাপ চিকিৎসার কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রা। তাই তাপমাত্রা বেশি হলে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। ঠান্ডা সেঁকে সরাসরি ত্বকে বরফ না ঘষাই ভালো। একটা কাপড়ে বরফ জড়িয়ে নিয়ে সেই কাপড় ব্যথার স্থানে ঘষলেই অনেকটা আরাম পাওয়া যাবে।
শেষ কথা
পরিশেষে বলা যায়, হাঁটু ব্যথা উপশমে ঠান্ডা ও গরম সেঁক উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তীব্র আঘাত বা ইনজুরির ক্ষেত্রে ঠান্ডা সেঁক প্রদাহ ও ফোলাভাব কমাতে সহায়ক, যেখানে দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা বা মাংসপেশির টান কমাতে গরম সেঁক সহায়ক। তবে, সঠিক উপায়ে ও সময়ে এই চিকিৎসাগুলি প্রয়োগ করা জরুরি, কারণ প্রতিটি ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা ও ব্যথার ধরন ভিন্ন। তাই সঠিক তাপমাত্রা এবং সেঁকের পদ্ধতি অনুসরণ করলে হাঁটু ব্যথা থেকে আরাম পাওয়া সহজ হবে।